গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রাতের আকাশে একটা ছোট আলোর বিন্দু হঠাত করে নিচের দিকে পড়ে যেতে আমরা অনেকেই দেখেছি। মনে হয় যেন আকাশ ভরা মিটমিটে তারাগুলো থেকে একটা বুঝি টুপ করে পড়ে গেল! এব্যাপারে বড়দের জিজ্ঞাসা করে এগুলো যে ‘খসে পড়া তারা’-ই, তাও হয়ত শুনেছি অনেকে। আবার এই ‘খসে পড়া তারার’ মত দেখতে জিনিসগুলি যে আদতে তারাই নয়, বরং এদের নাম ‘উল্কা’ তা-ও কেউ কেউ জানি। কিন্তু ‘উল্কা’ জিনিসটা আসলে কি অথবা উল্কাবৃষ্টি আসলে কেন হয়? আর কেনইবা উল্কাদের খসে পড়া তারার মত দেখায় এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরগুলি আমাদের অনেকের কাছেই কিছুটা ধোয়াটে।
উল্কার সংজ্ঞাটা বেশ সাদাসিধা। কোনো মহাজাগতিক বস্তু(সহজ কথায় যেসব বস্তু মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়) পৃথিবীর যথেষ্ট কাছে এসে পড়লে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে এটি ভূপৃষ্ঠের দিকে তীব্র বেগে এগুতে থাকে আর এসময় এর সাথে বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর সংঘর্ষে জ্বলে ওঠে। তখন যে ক্ষণস্থায়ী সরু আলোর রেখা দেখা যায়, তা-ই উল্কা। বেশিরভাগ সময়ই উল্কার আকার এত ছোট হয় যে এটি আসার পথেই জ্বলে ছাই হয়ে যায়। যদি এটি মোটামুটি বড় আকারের হয় তবে এর যে অবশিষ্টাংশ ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে তা হল উল্কাপিণ্ড।
কথা হল, কোন মহাজাগতিক বস্তু আসে এমনভাবে? পৃথিবীর চারপাশে শুক্র বা মঙ্গলের আগে পর্যন্ত তো তেমন কিছুই নেই, তাহলে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে প্রতি ঘণ্টায়ই যে গড়ে ৫টি উল্কাপাত দেখা যায়, তার উৎপত্তি কোথায়? উত্তর হল- অনেক জায়গাতেই! আসল কথা হল, সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট পরিচিত সদস্য গ্রহাণুগুলোও পৃথিবীর বেশ দূরে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু, এগুলো ছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট বালুকণা বা পাথরের টুকরোর মত পদার্থ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। আর মোটামুটি সিংহভাগ উল্কাই এসব কণার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জ্বলে ওঠার দৃশ্য। তাই এদের কেউই পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। প্রতি ১০০ বছরে হয়ত মাত্র কয়েকটি ছোট খাটো টুকরো পৃথিবী পর্যন্ত এসে পৌঁছে আর এখানে এসে বিশালাকার খাদ কিংবা ডাইনোসরদের বিলুপ্ত করে দেবার মত ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী উল্কা আসার সম্ভাবনা মোটামুটি প্রতি ৩লক্ষ বছরে একবার মাত্র। এগুলো হল গ্রহানু বেল্টের কোনো বিক্ষিপ্ত সদস্যর কাজ যেটি ঘুরতে ঘুরতে মঙ্গল ও পরে পৃথিবীর আকর্ষণে পথ বদলাতে গিয়ে শেষমেশ পৃথিবীর মহাকর্ষ বল এড়াতে না পেরে এখানে আছড়ে পড়ে।
সাধারনত, ভোরের দিকে সন্ধ্যার চেয়ে বেশি উল্কা দেখা যায়। কারণ, সেসময় পৃথিবীর গতির দিকেই উল্কাদের অবস্থান হয়। খালি চোখে আমরা যেসব উল্কা দেখি সেগুলো প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার উপরে থাকে আর এদের বেগ থাকে প্রায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার/সেকেন্ড।
এ তো গেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া উল্কার কথা। এখন আসি উল্কাবৃষ্টিতে। প্রতি বছরই কিছু নির্দিষ্ট দিনে আকাশে উল্কার পরিমান বেশ বেড়ে যায় (প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০/৪০ টি)- একেই বলে উল্কাবৃষ্টি। আর এই অসংখ্য উল্কা আকাশের একেকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই আসে। এই জায়গাগুলিকে বলে বিকিরণ বিন্দু বা ‘radiant’। এ থেকে মনে আসতেই পারে যে এগুলো নিশ্চয়ই একই মাতৃবস্তু থেকে আসছে; আসলেও তাই। সূর্যের কাছে যে সকল ধূমকেতু আসে সেগুলোর বিশাল আর সুবিস্তৃত বরফকণাপূর্ণ গ্যাসীয় লেজের যেসব অবশিষ্টাংশ এদের কক্ষপথের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকে, পৃথিবী তার চলার পথে এদের কাছে চলে আসলে মোটামুটি কাছাকাছি অঞ্চল থেকে এরা উল্কা হয়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। এভাবে একেকটি ধূমকেতুর ফেলে যাওয়া ধূলিকণার দঙ্গল থেকেই বেশিরভাগ উল্কাবৃষ্টি হয় বলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে একেকটি উল্কাবৃষ্টি হয়। আর এই নির্দিষ্ট বিন্দুগুলো মূলত আকাশের পটভূমিতে একেকটি তারামণ্ডলের মধ্যে থাকে। তাই অবস্থান সনাক্তকরণ সহজ করতে একেকটি উল্কাবৃষ্টি যে তারামণ্ডলের পটভূমিতে হয়- তার নামকরণ সেই তারামণ্ডলের নামানুসারে হয়। এসময় সেই মণ্ডলের নামের শেষে সাধারনত –ids অথবা –nids যোগ করা হয়। অনেক সময় মণ্ডলের নামের শেষের দু-একটা বর্ণ বাদ দিয়েও শেষাংশ যোগ করা হয়। যেমনঃ আগস্টের ১২ তারিখে যে উল্কাবৃষ্টি দেখা যায় তার নাম ‘পারসেইডস’ (perseids)উল্কাবৃষ্টি যেটির নামকরণ হয়েছে পারসিয়াস তারামণ্ডল থেকে আর এটি হয় ‘সুইফট টাটল’ নামক ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশ থেকে। অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে দেখা যায় ‘ওরায়নিডস’ (orionids) নামক উল্কাবৃষ্টি যেটির নামকরণ আর কারণ যথাক্রমে কালপুরুষ মণ্ডল আর হ্যালির ধূমকেতুর অবশিষ্ট। নিচের ছকে বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উল্কাবৃষ্টির নাম ও সময় দেওয়া হলঃ
নাম —সর্বোচ্চ উল্কাপাতের দিন (সাধারণত)
কোয়াড্রানটিডস (Quadrantids) —জানুয়ারী ৩
লাইরিডস (Lyrids) —এপ্রিল ২১
ইটা অ্যাকুয়ারিডস (Eta Aquarids) — মে ৫
পারসেইডস (Perseids) —আগস্ট ১২
ওরায়নিডস (Orionids) —অক্টোবর ২০
লিওনিডস (Leonids) —নভেম্বর ১৭
জেমিনিডস (Geminids) —ডিসেম্বর ১৩
এই দিনগুলিতে বা তার একদিন আগে-পরের দিনে ঢাকার মত আলো-দূষণময় শহরগুলি ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গাতেই থাকো না কেন, রাতের আকাশে ঘন্টাখানেক তাকালে ৩০/৪০টা না হলেও, অন্ততপক্ষে ৫/১০টা উল্কা চোখে পড়বেই। আর ভাগ্য ভালো হলে একসাথে কয়েকটাও দেখা যায় মাঝে মাঝে। ব্যাখ্যা জানা থাকুক আর নাই থাকুক, তারাভরা আকাশ দেখা যেমন মজার, উল্কা, ধূমকেতু, গ্রহণের মত মহাজাগতিক ঘটনা দেখা আরও বেশিই মজার। তাই এসব সময় উপযুক্ত জায়গায় থাকলে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ফেলাই ভালো। আর সেই সাথে ব্যাপারটা কি আর কেনো হচ্ছে তা জানা থাকলে তো কথাই নেই!
দ্রষ্টব্যঃ লেখাটা ২০১৫ সালের। এটাও কোনো ম্যাগাজিন বা শিশু সংকলনের জন্য লেখা। পুরনো লেখাগুলি জড়ো করে রাখতেই রেখে দিচ্ছি এখানে।