মার্চ, ২০১৬
অনেক অনেকদিন পর মোটামুটি এক নিঃশ্বাসে একটা বই পরে ফেললাম। ছোটবেলায় গ্রামে যখন ছিলাম, সন্ধ্যে হলেই কিছুক্ষণ নামেমাত্র পড়াশোনা করে দাদুর কাছে বসে যেতাম আমরা দুই ভাইবোন। বেশিরভাগ সময়েই লোডশেডিং চলতো আর উঠোনে খোলা আকাশের নিচে বসে হাতপাখার বাতাস খেতে খেতে আমরা শুনতাম দাদুর জীবনের গল্প- কিভাবে বরিশালের মশাং নামক এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মাত্র দশ বছর বয়েসে বিয়ে করে এই সংসারে এলো- কিভাবে অনেক দিন পর্যন্তই এই বড় বাড়িতে মন খারাপ করেই তার সময় কেটে যেত- কিভাবে সে কোনও কাজ না জেনে এলেও সময়ের সাথে সব শিখে সংসারের হাল ধরলেন – কিভাবে সংসারের ভালো মন্দ সময়গুলো গেলো- কখন একেকটা অসময়ের মৃত্যু এসে জীবনটা ওলট পালট করে দিলো- কিভাবে তারপরেও জীবন এগিয়ে গেলো- কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা তারা পার করলেন- এমন হাজারও জীবনের গল্প শুনতে শুনতে ছোটবেলায় কোথায় যে হারিয়ে যেতাম! একটু বড় হবার পর থেকেই তাই মাথায় ঘুরছে যে তার এই সব গল্প- সবকিছু যেভাবেই হোক লিখে ফেলতে হবে। পৃথিবীতে কত কি হয়ে যায়- তার প্রভাব একেবারেই কারও সাতে-পাঁচে না থাকা নিরীহ মানুষের জীবনে কিভাবে আন্দোলন বয়ে আনে, তা সত্যিই স্তব্ধ করে দেয় সময়ে সময়ে। আগুনপাখি বইটি পড়ে মনে হচ্ছিলো আমার দাদুর গল্পই যেন পড়ছি!
গাঁয়ের এক সাধারণ মেয়ের জবানিতে লেখা তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের গল্প। তার বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে আসার গল্প। বিরাট সংসারে ছায়া দিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা মেনে নিয়ে যা আছে তাই নিয়ে হাসিমুখে পার করে দেয়া সময়ের গল্প। এর মাঝেই জন্ম- মৃত্যু – হাসি – কান্না মিলে জীবন এগিয়ে যায়। পুরো বইটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল মাটির গন্ধ আর একমাত্র মায়ের মনেই থাকা সম্ভব এমন মায়া। কোনও কিছুই মুখফুটে না বললেও যে মানুষ তার পরিবারের মানুষগুলোর সংসার টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম অকপটে বুঝে নিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে যাচ্ছে তাকে ভালো না বেসে কি পারা যায়! তাই বইটি পড়তে গিয়ে নিজের অজান্তেই কখনো হেসে কুটিকুটি হয়েছি, কখনো বুক ভেঙ্গে যেতে চেয়েছে হাহাকারে। বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড় আন্দোলন, দেশ বিভাগ, মঙ্গা- এসবকিছুকেই একেবারে আটপৌরে জীবনের কাছ থেকে দেখতে পেলাম যেন। আর শেষে এসে এই সর্বংসহা সরল মেয়ের জীবনে একবার অবাধ্য হবার সময়ও তাই তাকে সমর্থন না জানিয়ে পারলাম না। অসাধারণ বই!