আগস্ট, ২০১৯

প্রথম প্যারিস কাটাকম্বের কথা পড়ি আমি কোনো এক বইতে, খুব সম্ভবত ড্যান ব্রাউনের ‘ দ্য ভিঞ্চি কোড’ বইতেই। কিন্তু, গত সপ্তাহান্তে প্যারিস বেড়াতে যাবার প্ল্যান যখন শুরু করেছি গতমাসে, তখন এই জায়গার কথা প্রথমে একেবারেই মাথায় আসেনি। প্যারিস – বা পারী – ছোটবেলায় স্কুলের বইতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘পারী’ ভ্রমনকথা পড়েই প্রথম মাথায় বসে যায় যে জীবনে সম্ভব হলে কোনোদিন চর্মচক্ষে দেখতে চাই শহরটা! এরপরে আঁকিবুঁকি আর বিশেষকরে রেনেসাঁ আর তার পরবর্তী সময়ের ইম্প্রেশনিজমের ব্যাপারে আগ্রহ হওয়ায় যাবার ইচ্ছা আরও বাড়েই। সময়ের ফেরে দেশে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ২০১৬ সালে ইউরোপ আসি মাস্টার্সে। দু’বছরে ইরাস্মুস প্রোগ্রামের কল্যাণে তিন দেশে (অস্ট্রিয়া, ইতালি, সার্বিয়া ) থেকে আর আশেপাশের কয়েক দেশে ঘুরেও ফ্রান্সে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। শেষমেশ পিএইচডি শুরুর প্রায় এক বছর পরে কাজের চাপে চ্যাপ্টা এক উইকেন্ডে গতমাসে হুট করেই ভাবলাম প্যারিস যাবো! তো এতো কাহিনী বলার মূল কারণ হল যে প্যারিসে আমার দেখার যায়গার তালিকা অনেকদিনে জমে উঠে বেশ বড়ই ছিল। এমনিতে গত কয়েকবছরে আমার বেড়ানোর ধরণ হয়েছে এমন যে কখনো অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করিনা। শেষমেশ কী দেখলাম আর কী দেখলাম না মিলেমিশে মাথা ভার হয়ে থাকে আর মুগ্ধতার চেয়ে ক্লান্তির পাল্লা ভারি হয়ে যায় মনে হয়। কিন্তু, প্যারিসের ব্যাপারে এই নিয়মটা মানতে পারলাম না। একে তো অনেক অনেক কিছু দেখার, তালিকা ছোট করেও খুব কমে না, তার উপরে আগস্ট হল ইউরোপে মানুষের বেড়াতে আসার সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। অন্যান্য মহাদেশ থেকে তো বটেই, ইউরোপের নানা দেশ থেকেও প্রচুর মানুষ এসে জমা হয় এই কল্পনার মিশেলে গড়া নগরী পারী তে। ফলে সমস্ত দর্শনীয় জায়গায় উপচে পড়া ভিড় আর বিষম লম্বা লাইন। আগে থেকে কোথায় যাবো ঠিক করে টিকেট করে না গেলে দিনে একটার বেশি জায়গায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব, আর শান্তি করে দেখার প্রসঙ্গ তো বাদ। কাজেই যাওয়া আসা মিলে আমার আর রুসলানের মোটে সাড়ে চারদিনের প্ল্যান একেবারে ঘণ্টা হিসেব না করলেও বেলা হিসেবে করে গিয়েছি প্রায়। ল্যুভর, অর্সেই গ্যালারি, ভার্সাই প্রাসাদ, আইফেল, শাঁযেলিজে বুলভার্দ, মন্মার্ত, আর্ক দ্য ত্রিওম্ফ – ইত্যাদি তো ছিলই, মনে হল একটু আলাদা কোন জায়গায় যাওয়া যায়? কিছুক্ষণ নেট ঘাঁটতেই দুটো খুবই ভালো অপশন পেয়ে গেলাম। এই কাটাকম্ব, আরেকটা প্যেরে লাশেজ সেমেটারি। দুটো জায়গাতেই শেষ পর্যন্ত গিয়েছি, আর আলাদাভাবে মুগ্ধ হয়েছি! কাটাকম্বের নাম শুনে সেই ভাসাভাসা স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে পড়লো না, তাই নেট ঘাঁটতে গিয়ে পেয়ে গেলাম এক চমকপ্রদ ইতিহাস। ভাবলাম, এটা দিয়েই শুরু হোক আমার টুকটাক বেড়ানোর গল্প লেখা!

পারী শহরটাকে অনেকেই তুলনা করে একটা অনেক বড় সুইস চিজের টুকরোর সাথে! উপর দিকে যতোই সমতল বা হাল্কা পাহাড়ি দেখাক, একটু মাটির ভেতর দিকে নামলেই মেট্রো লাইনেরও নিচে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০ মাইল লম্বা সুরঙ্গ আছে। এই সুরঙ্গগুলি কীভাবে আসলো জানতে আমাদের প্রায় ৫৩ মিলিয়ন বছর আগে একটু ঢুঁ মেরে আসতে হবে। এখনকার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা পারীর জায়গায় তখন কেবল এক পলিমাটি জমা জলাভূমি – বা সোয়াম্প ছিল। সেই জলা সময়ের সাথে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর আগে পরিণত হয় এক উষ্ণ পানির সাগরে; এখনকার ফ্রান্সের পুরো উত্তরাঞ্চল জুড়ে থাকা এই প্রাগৈতিহাসিক সাগর তাতে থাকা অসংখ্য মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী, জলা গাছ আর শ্যাওলাসহ নানান প্রাকৃতিক কারণে আর ভূমিধ্বসে আস্তে আস্তে শুকিয়ে সমতল হয়ে আসে। আর এই জমাট পলিমাটি আর জীবের দেহাবশেষ জমে হয় এক চুনাপাথরের ভাণ্ডার। অনেককাল ধরে অনাবিষ্কৃত এই ভাণ্ডার এসে কাজে লাগে রোমান সাম্রাজ্যের সময়! রোমানরা এই এলাকায় এসে প্রথমে চারপাশের পাহাড় থেকে চুনাপাথর এনে ঘরবাড়ি তৈরি করে পত্তন করে ‘লুটেশিয়া’ নামের এক নগর – যা নানান পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের পরে হয়ে যায় আজকের পারী! পাহাড়ে জমা পাথর শেষ হয়ে গেলে তারা মাটি খুঁড়ে তুলে আনতে থাকে। এখনকার হিসেব মতে সবচেয়ে প্রাচীন মাটি খুঁড়ে পাথর বের করার নিদর্শন খৃস্টীয় প্রথম শতকের। তো রোমানরা যাবার পরে ফ্রাঙ্ক’রা এসে জোরেশোরে নগর বাড়ানোর কাজে লেগে গেলে সেই মাটিখোঁড়া খানাখন্দ বাড়তে বাড়তে হয়ে যায় মাইলের পর মাইল লম্বা সুরঙ্গ, এই বিশেষ চুনাপাথর তার মানের কারণে পায় নতুন নাম, ‘প্যারিস স্টোন’ । আর উপরে উঠতে থাকে একের পর এক বিশাল নামকরা দালান যেগুলোর অনেকগুলিই এখনো আমরা দেখি – নতর দাম ক্যাথেড্রাল, ল্যুভর প্রাসাদ, লাতিন কোয়ার্টার ইত্যাদি। এখন পর্যন্ত ও সব ঠিক ছিল।
বরং একটু বেশিই ভালো চলছিলো সবকিছু, এই ক্রমবর্ধিষ্ণু নগরের নাম যশ বাড়ে, এ হয়ে ওঠে শিল্প-সাহিত্য-ব্যবসা সবকিছুর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। উপরে নগর বাড়ে, আর নিচে বাড়ে সুরঙ্গের দৈর্ঘ্য। প্রথমে এ সুরঙ্গ নগরের সীমানার বাইরে থাকলেও ১৭’ আর ১৮’ শতক নাগাদ শহরের সীমা এতোটাই বাড়ে যে, সুরঙ্গ শহরের নিচেই চলে আসে। আর তখনই শুরু হয় ঝামেলা। বাড়তে থাকা বাড়িঘর আর দালানের বোঝা এই ফাঁপা মাটি সইতে না পেরে বিভিন্ন জায়গায় দালান আর রাস্তা ধ্বসে পড়তে শুরু করে। ১৭৭৪ সালে রু দেফের রশের্যু তে প্রায় ৩০০ মিটার এলাকা ধ্বসে পড়লে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। সেসময় সম্রাট ষোড়শ লুই ১৭৭৬ সালে আইন জারি করে যে রাস্তার নিচের কোনো খনি থেকে পাথর তোলা নিষিদ্ধ। সেই সাথে ১৭৭৭ সালে সুরঙ্গ আর খানাখন্দ আসলে কতদূর ছড়িয়ে আছে তা হিসেব করতে, আর যেসব জায়গায় ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেখানে ভিত মজবুত করার ব্যবস্থা করতে এক বিশেষ কমিটি ও তৈরি করেন। এই কাজের দায়িত্ব পরে তার রাজস্থপতি Charles-Axel Guillaumot এর ঘাড়ে।

এই সমস্যার পাশে তখন পারীতে চলছিলো আরেক বড় সমস্যা। একে তো পয়ঃনিষ্কাসনের লাইন সব রাস্তার উপরেই, দূষিত পানি খেয়ে মানুষ নানান অসুখে ভুগছে, তার উপর শহরের কোনো কবরখানায় আর এক চিলতে জায়গা নেই। বাড়ন্ত শহরে কাজের সন্ধানে আসা অসংখ্য মানুষ মধ্যযুগের নানান অসুখবিসুখে, যুদ্ধে, প্লেগ মহামারীতে এতো বিপুল সংখ্যায় মারা গিয়েছে যে একই কবরে একের পর এক কবর দিয়ে, আবার বড় কবর খুঁড়ে গণকবর দিয়ে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। আবার বারবার এক কবর খোঁড়া হচ্ছে দেখে লাশ পচা গন্ধে শহরের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে থাকে। এমনকি সুগন্ধির জন্য যে শহর পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত, সেখানের সুগন্ধির ব্যবসায়ীরাও সম্রাটের কাছে নালিশ জানাচ্ছে যে পাশের মাইলটাক দূরে থাকা কবরখানার গন্ধেও তাদের ব্যবসা লাটে উঠছে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে একবছর বর্ষায় বেশ ভারী বৃষ্টি হল। তাতে এক বিশাল কবরখানার এক পাশের দেয়াল ভেঙ্গে প্রচুর আধাপচা গলে যাওয়া মরদেহ উঠে আসলো। এই ভীষণ পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্রাট বের করলেন এক সময়োপযোগী সমাধান। তা হল, এইযে সুরঙ্গর হিসেব নিকেশ হচ্ছে, এগুলো তো ফাঁকাই পড়ে আছে। এখানে পুরনো মরদেহগুলো সরিয়ে ফেললে শহরেরও গতি হয়, জায়গাগুলোও ব্যবহার হয়। সেই থেকে দু’ বছর টানা কাজ করে ১৭৮৫ সাল নাগাদ প্যারিসের সব সেমেটারি থেকে দেহাবশেষ রাতে রাতে সরিয়ে কাটাকম্বে স্থানান্তর করা হল। যেহেতু সব মরদেহ ধর্মীয় জায়গা থেকে নেয়া হচ্ছে, তাই সাথে একদন পাদ্রী থেকে এই স্থানান্তরের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতেন। তবে এই সময়ে এইসব হাড়গোড় সাজিয়ে কিছু করার চিন্তা করেনি তারা, শুধু স্তূপ করেই রাখা হয়েছিলো।

এর মধ্যে হয় ফরাসী বিপ্লব, রাজতন্ত্র হঠিয়ে নেপোলিয়ন আসে ক্ষমতায়। তার এক বিশ্বাস ছিল যে মানুষষের কীর্তির চিহ্ন তার রেখে যাওয়া স্মৃতিস্তম্ভেরাই সবচেয়ে ভালো বহন করে! আর ততদিনে ইউরোপের আরেক নামকরা নগরী রোমের কাটাকম্ব বিখ্যাত। তার মনে হলো যে প্যারিসেও এক বিখ্যাত কাটাকম্বের মনুমেন্ট হবে। এদিকে কবরখানা থেকে হাড়গোড় বা দেহাবশেষ কাটাকম্বে নিয়ে একরকম স্তূপ করে রাখার কারণে সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। শুধু একেক কবরখানার দেহাবশেষ একেক সুরঙ্গে রেখে সেখানে ওই কবরখানার একটা ফলক রেখে আসা হতো যাতে বোঝা যায় যে কোথা থেকে এসেছে এগুলো। তো এই দুই মিলিয়ে নেপোলিয়নের নির্দেশে শুরু হয় আজকের ‘সুন্দর’ দেখতে কাটাকম্ব তৈরি! একেবারেই পচে যাওয়া হাড়গোড় আর দেহাবশেষ সরিয়ে আলাদা করে বিশেষ ভাবে রেখে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেসব জায়গা। বাকি হাড়গোড় লাইন ধরে সাজিয়ে রাখা হয়। তাদের মাথায় ছিল যে, জায়গাটা মানুষজন দেখতে আসবে, মৃতদের আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও সাধারণ মানুষ, শুধু স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে। সেই চিন্তা থেকে তারা বেশ অদ্ভুৎ দর্শন হাড়-ভাস্কর্য তৈরি করে কাটাকম্ব জুড়ে। ১৮৫৯ সাল নাগাদ প্যারিসের ১৫০টা কবরখানা থেকে এখানে দেহাবশেষ এসে জমা হয়। প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের দেহাবশেষ আছে এখানে এখন! পুরো কাটাকম্বের সবটুকু জায়গা এই কাজে লাগে না। বাকি জায়গায় হয় বিখ্যাত শ্যাম্পিনিওন দ্য পারী (বা প্যারিসের মাশরুম! ) এর চাষ, আর বিয়ার তৈরির কারখানা। এরপরেও এই ২০০ মাইল লম্বা গোলকধাঁধার অনেক অংশই আমাদের যাতায়াত সীমার বাইরে। অনেক জায়গা ধ্বসে গিয়েছে, অনেক জায়গায় বাইরে থেকে পানির স্রোত এসে বন্ধ করেছে, কিছু জায়গা সেই প্রথম ম্যাপিং এর সময়ই হিসেব করা যায়নি। কাটাকম্বের টিকেট কেটে ঢুকলে আমরা মাত্র ২ কিলোমিটার জায়গা দেখি।

তৈরির সময় থেকেই যুগে যুগে নানান উটকো মানুষের দল কাটাকম্বকে ঘিরে নানান অদ্ভুৎ গল্প ফেঁদেছে, বেআইনি ভাবে কাটাকম্বে গিয়ে কালোজাদুর চর্চার চেষ্টা করেছে! তাই এই চমকপ্রদ জায়গা দেখতে প্যারিসের সব দর্শনার্থী না আসলেও কম আসে না! যেটুকু জায়গা দেখা যায়, প্রায় ২০ মিটারের বেশি মাটির নিচে, আর সমস্ত হাড়গোড়ের পচন ঠেকাতে নিয়ম করে কখনোই একসাথে ২০০ জনের বেশি যেতে দেয়া হয়না। আর নিচে তাপমাত্রা সবসময় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখা হয়। আমরা প্যারিস গিয়ে ছিলাম সাগরদার বাসায়। উনি বললেন যে গত ৯ বছরের বেশি সময় ধরে প্যারিস থাকলেও তার কখনো যাওয়া হয়নি। কয়েকবার কেউ বেড়াতে আসলে তাদের সাথে গিয়েছেন, কিন্তু ভীষণ লম্বা লাইন দেখে আর সাহস করে যাননি। তো আমি আর রুসলান ওইদিন সকাল ৭টায় উঠে ভারসাই যাই। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার হেঁটে ক্লান্ত অবস্থায় ফিরে ঠিক করি যে আর কবে আসবো, লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি! প্রায় দু’ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে যেতে পারলাম!
ঢুকতেই পেঁচানো সিঁড়ি নেমে গিয়েছে টানা ২০ মিটারের গভীরে। আমরা ঢোকার সময় আগে যাওয়া একজন ভদ্রমহিলা উঠে আসছিলেন, উনি সিঁড়ি দিয়ে সম্পূর্ণটা নামতে পারেননি, মাথা ঘুরছিল দেখে উলটো চলে আসছিলেন! নামতে নামতে আমারও একসময় মাথা ঘুরে আসছিলো। নেমে প্রথমে কিছু সাধারণ চুনাপাথর কাটা সুরঙ্গ। একটু পরে কয়েকটা লাগোয়া ঘরের মতো জায়গা, সেখানে কয়েকটা ভাষায় কাটাকম্বের ইতিহাস লেখা, সাথে কিভাবে কবর খুঁড়ে দেহাবশেষ আনা হল, কিভাবে সনাক্ত করা হল কোনটা কার শরীরের হাড়, কিভাবে কোনটা কোন সময়ের এটা ঠিক করা হলো, এসবের বিবরণ। জানলাম যে, কোনো কোনো কবরে এমনকি ৬টা স্তরে দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে! আর সবচেয়ে বড় গণকবরে ৬ স্তর মিলিয়ে ২৩০ জন মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে! খুব সম্ভবত প্লেগ মহামারীর সময়কার এক গণকবর ছিল সেটা। এরপরে হাড়ের সুরঙ্গ বা অসুয়ারি শুরু হয় এক নামফলক দিয়ে, সেখানে লেখা, ‘Arrête! C’est ici l’empire de la Mort’ বা ‘সাবধান! এখানে মৃতদের সাম্রাজ্য!’ ভেতরে ঢুকতেই নানান সজ্জায় হাড় দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য, মূলত ঠাসবুনটে সাজিয়ে রাখা হাড়ের সারি, মাঝে মাঝে মাথার খুলি দিয়ে আকা হৃদয়, ক্রস, বা কলাম। জায়গায় জায়গায় আবার একটু অর্ধবৃত্তাকার ফাঁকা জায়গা করে প্রার্থনার স্তম্ভ করা। মৃতদের আত্মীয়রা বা যে কেউ যাতে তাদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে পারে সেই ব্যবস্থা, মাটির নিচে গির্জা তো আর বানাতে পারেনা, তাই। আর প্রতিটা সারির সাথে যেই কবরখানা থেকে এগুলো এসেছে সেখানের নামফলক। শেষের দিকে এসে হাড় দিয়ে তৈরি বড় এক ব্যারেল আর কিছু চাতাল মতো ভাস্কর্য ও আছে। এগুলোর বেশিরভাগই দু’শ বছরেরও আগে করা!

জায়গাটায় রাতের অন্ধকারে একা যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, এমনিতে অশরীরীর ভয় অনেক আগেই চলে গিয়েছে তারপরেও, কিছুটা গা ছমছমে অনুভূতি তো বটেই। তবে একসাথে আরও কিছু অনুভূতি কাজ করছিলো – মৃত মানুষের হাড়গোড় আর শহরের নিচের ফাঁপা জায়গার সমস্যা – এখন থেকে কয়েকশো বছর আগেও কতোটা বাস্তববাদী হলে এমন সমাধানে আসা যায়! আর সেটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এখনো কতো সুন্দর রাষ্ট্রীয় আয় হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে দেশের অদ্ভুত ইতিহাস দেশ বিদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা যাচ্ছে। আমাদের দেশের কতো চমকপ্রদ ইতিহাস আছে নিজেরাই জানি না ঠিকমতো, গুছিয়ে দেখানো তো দূরের কথা! আরেকটা বোধ হচ্ছিলো যে, একেকটা সারিতে এইযে হাজার হাজার হাড়গোড়, প্রতিটাই কোনো না কোনো মানুষের অংশ ছিল – আমি এমন হাড়গোড় হয়েই যাবো, এমন স্মৃতিস্তম্ভের অংশ না হয়ে মাটিতে মিশে জীবন – মৃত্যুর চক্রে মিশে যাবো। কী দরকার যতদিন বেঁচে আছি, ঝামেলার পেছনে সময় নষ্ট করার। স্মৃতিরাই শুধু আমার সাথে থাকবে শেষ পর্যন্ত!