লিখছি ২১ এপ্রিল, ২০২৩। আজ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই মুসলিমরা ঈদ-উল-ফিতর পালন করছে, আমি এখন আছি নেদারল্যান্ডে, এখানেও। বাংলাদেশে আগামীকাল, আজকে ‘চাঁদ রাত’। আজ এখানে শুক্রবার দেখে অফিস খোলা ছিলো, আলাদা করে কোনো প্ল্যান ও করা হয়নি। তাই অফিস থেকে ফিরেছি সন্ধ্যের একটু আগে। এসে দেশে বাবা মায়ের সাথে কথা বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে বাজারে গেলাম, এসে চট করে কিছুটা ঈদের আমেজ আনতে দেশি ঈদের খাবারের কাছাকাছি কিছু রান্না করে খেয়েদেয়ে কাজে বসলাম আবার। প্রবাসে, বিশেষ করে যারা পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে আসে, অন্তত কয়েকটা ঈদ আমাদের সবারই এমন যায় – সারাদিন দৌড় আর কাজ, বাসায় ফিরে হয়তো অল্প কিছু রান্না। ভালো ঈদের আয়োজন মানে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বা বন্ধুদের সাথে রাতের খাবারের আয়োজন, দেশ থেকে আগে নিয়ে আসা বা দেশ থেকে পাঠানো জামাকাপড় পরে ছবি তোলা, অথবা ঈদ উপলক্ষে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। এইযে ভালো আয়োজনের কথা লিখলাম, এমন কিছু আমার গত সাত বছরে বাইরে এসে একবারও করা হয়নি, অবশ্য দেশে থেকেও আনন্দ করে ঈদ উদযাপন শেষ কবে করেছি খুঁজতে গিয়ে ১২/১৩ বছর আগের স্মৃতি মনে আসলো মাত্র, এর পরের অনেক কিছুই অনেক বদলে গিয়েছিলো। তবে আজকে ঈদের রান্না করতে গিয়ে আরও অনেক আগের, একদম সাদাকালো টেলিভিশন যুগের নয়েজ মেশানো (আমরা বলতাম ছবি ‘ঝিরঝির’ করে) আবছা ঘোলাটে ভিডিওর মতো কিছু স্মৃতির টুকরো কেমন ধুপ করে মনে পড়ে গেলো।
এই মনে পড়ে যাওয়ার কারণ আসলে দুটো, প্রথমটা আজকের খাবারের আয়োজন। আমি খেতে ভালোবাসি, পরিমাণের চেয়ে স্বাদ আর বৈচিত্রেই আগ্রহ বেশি। সেই সাথে যেকোনো খাবারের সাথে আগের ভালো কোনো স্মৃতি জড়িয়ে থাকলে তো কথাই নেই, সময় হলে শুধু ভালো স্মৃতি রোমন্থন করতেও একেক সময়ে রান্না করে ফেলি বিশেষ কিছু, অন্তত আমার কাছে বিশেষ কিছু। এই ব্যাপারটা আমার মনে হয় যেকোনো দেশের ভোজনরসিক মানুষের মধ্যে আছে, বাংলাদেশি মানুষের মধ্যে এটা আরও একটু বেশি বই কম নেই। যাহোক, আজকে কম সময়ে কিন্তু উৎসব উৎসব মনে হবে এমন কী করা যেতে পারে ভাবতে গিয়েই প্রথমে ছোটবেলায় ফিরে যাই।
তখন আমার বয়স ৬-৮ এর মধ্যে কিছু, বাবা কাজের জন্য নাটোরে থাকতেন। মা তাঁর কলেজের শিক্ষকতার জন্য আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতেন আমাদের দাদাবাড়িতে, মাদারীপুরে।মা কলেজে থাকার সময়টায় আমরা দাদু, ছোট ফুপু, আর ছোট চাচার কাছে থাকতাম। ২০০০ সালের আগের কথা, সেসময় আমাদের গ্রামে টেলিফোন ছিলো না, বাবাকে আমরা চিঠি পাঠাতাম, বাবাও আমাদের লিখতেন। মাঝে মাঝে কাছের উপশহরের এক পরিচিত দোকানে (বা কারো বাসায়, ঠিক মনে নেই) গিয়ে বাবার সাথে ফোনে কথা বলতাম, আমার এক বা দুইবারের কথা মনে আছে শুধু, তাও খুবই ঝাপ্সা ভাবে। সেই ফোনেও কবে কখন কথা বলা হবে সেটা চিঠি লিখে ঠিক করে নিতে হতো। তো সেই ছোট গ্রাম থেকে বাসে করে নাটোরে যেতে ৭ ঘণ্টার বেশিও লেগে যেত কখনো কখনো। বাবার ঔষধ কোম্পানির নতুন চাকুরীতে ছুটি খুবই কম ছিল। তাই বছরে হয়তো একটা ঈদ বাবা আমাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে করতেন, তাও যাওয়া আসা মিলে তিন-চার দিনের ছুটিতে। এছাড়া হয়তো বছরে একবার আসতেন কখনো হঠাত ছুটি পেলে। তাই মায়ের কলেজ ছুটির সময়ে আমরা নাটোর চলে যেতাম। বিশেষ করে রমজান মাসে রোজা আর ঈদ মিলিয়ে, গরমের ছুটিতে, আর কখনো দুর্গাপূজার ছুটিতে। একবার একটা মজার ব্যাপার হয়।
আমরা কোনো একটা ছুটিতে নাটোর যাচ্ছি, সেসময় কুষ্টিয়া আর ঈশ্বরদীর মাঝে পাকশি ফেরি পাড় হতে হতো মাদারীপুর থেকে নাটোর যাওয়ার পথে। যাওয়ার আগে মা বাবাকে চিঠি দিয়েছে কিন্তু গিয়েছে কিনা জানি না আমরা। তো আমি আর রিফাত খুবই এক্সাইটেড নাটোর যাচ্ছি তাই, কারণ নাটোর যাওয়া মানেই বাবার সাথে দেখা, সারাদিন খেলা আর কমিক পড়া, পড়াশোনার ঝামেলা নেই। দুইজন বাসের জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি আর বকবক করছি। মা আমাদের দুইজনকে সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে হয়তো একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলো। আমরা ফেরি থেকে নামছি তখন পাশ দিয়ে অন্য বাস ফেরিতে উঠছে। হঠাত করে একটা বাসে বাবার মতো কাউকে দেখে আমরা দুইজনই একসাথে বাবা বলে চিৎকার করে উঠি। যাকে দেখি তিনিও চমকে পেছন ফিরে তাকান, কিন্তু বাসটা চলে যায়। এদিকে আমাদের চিৎকারে মা উঠে গেলো, আমরা দুইজন উত্তেজিত হয়ে বাবাকে দেখেছি এটা মা কে বলতে গেলাম। আর আমরা অনেকদিন বাবাকে না দেখে পথের মাঝখানে কাকে না কাকে বাবা ডেকে চিৎকার করছি এই নিয়ে মা বিব্রত হয়ে আমাদের চুপ করাতে চেষ্টা করছেন। মজার ব্যাপার হল, সেটা বাবা-ই ছিলো! যেই ছুটিতে আমরা যাচ্ছিলাম, সেই একই উপলক্ষে (একদমই মনে নেই) বাবাও হঠাত করেই তিনদিনের ছুটি পেয়ে যান, আর তাই আমাদের সারপ্রাইজ দিতে কিছু না জানিয়েই ডাসার যাচ্ছিলেন। একারণেই মায়ের চিঠি ও পাননি। এরপর একদম ঠিক কী হয় তা সঠিক মনে নেই, তবে বাবা ওই বাস ফেরিতে উঠে থামলে পরে নেমে এসে আমাদের বাসে করে নাটোরে ফিরেছিলো খুব সম্ভবত।
প্রসঙ্গ বদলে অনেক দূরে চলে গেলাম। বলছিলাম খাবারের কথা! নাটোরে থাকার সময়টা অনেক কারণেই আমার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিগুলির মধ্যে আছে, সেসব কথা আরেকদিন বিস্তর লিখবো হয়তো! তবে আজকে রান্না করতে গিয়ে নাটোরের বাসায় রাতের খাবারে হঠাত ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করলে মা যা রাঁধতেন তাই মনে পড়েছে। সেখানে বাবা এটাচ বাথসহ এক রুম নিয়ে থাকতেন তখন, একা মানুষ। সেই বাসার বারান্দায় একটা কেরোসিন তেলের স্টোভ আর দুই একটা শেলফ মিলে প্রক্সি রান্নাঘর। যেই বাড়িতে এই ঘর, সেখানে আমরা নিচতলায় থাকতাম। বাবার মতো আরও একজন চাকুরীজীবী একা একটা রুম নিয়ে থাকতেন, এই দুইটা রুম আর বাইরের বারান্দা ওই বাড়ির বাইরের গেইটের দিকে ছিল। আর দুইটা পরিবার থাকতো বাড়ির ভেতরের দিকে। সবাই রান্নার জন্য ভেতরের দিকে একটা বড় রান্নাঘর শেয়ার করতো। আমরা গেলে মা ও ওই রান্নাঘরে বেশিরভাগ রান্না করতেন। তবে অসময়ে কিছু রান্না বা চা-নাশতা করতে গেলে বারান্দার প্রক্সি রান্নাঘরে কাজ চলতো। সেখানে আগে থেকে দিনে প্ল্যান না থাকলে সন্ধ্যায় কখনো ‘ভালো কিছু’ খাবার বায়না করলে মা চট করে সামান্য মশলায় সাদা পোলাও, আর ডিমের মিষ্টি কোরমা করতেন, সাথে সালাদ। এই খাবার কতবার খেয়েছি, সাথে অন্য কিছু কী ছিলো, কিছু আমার এখন মনে নেই। এর পরে মায়ের হাতের আরও কতো কী খেয়েছি, ভীষণ মজার সব কিছুই। কিন্তু নাটোরের সেই ছোট বাসার বারান্দায় শীতের রাতে রান্না মায়ের হাতের সেই গরম গরম পোলাও আর মিষ্টি ডিমের কোরমার স্বাদ এখনো মনে গেঁথে আছে।
হয়তো সেই রান্না অনাকাঙ্ক্ষিত স্পেশাল খাবার ছিলো তাই, হয়তো সেই খাবারের স্মৃতি নাটোরের সব মিলিয়ে থাকা ভালো স্মৃতির অংশ ছিলো তাই, কে জানে! কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ঠিক এই সিম্পল খাবারটাই খুব খেতে ইচ্ছে করে। বড় হওয়ার একটা সুবিধে হলো, খেতে চাইলে নিজে রান্না করে ফেলা যায় :p মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে ঠিক এই কোরমাটাই শিখেও নিয়েছি আমি। শুধু সামান্য গোটা গরম মশলা, পিঁয়াজ কুঁচি আর বাটা, দুধ, চিনি, লবণ, আর কাঁচামরিচ দিয়ে খুব কম সময়ে করে ফেলা যায় আমার এই অমৃত! আজকে অফিস থেকে ফিরে প্রথমে ভাবছিলাম ঈদের রান্না কালকে করবো, কিন্তু রোদ ঝলমলে দিনের শেষে সন্ধ্যায় সহসা ঘটা করে আকাশ কালো করে মেঘ এলো, এরপর বিদ্যুৎ চমকে দমকা হাওয়া দিয়ে দেশি কালবৈশাখীর মতো ঝড়-বৃষ্টি এলো। দেখেই মনে হলো, নাহ, কিছু একটা ভালো রান্না করতে হবে, তবে চটজলদি কিছু! সেখান থেকে এই ইতিহাস! সাথে দেশি কালোজিরা চালের ঝরঝরে সাদা পোলাও, বেগুন ভাজা, গুঁড়ো মশলায় গড়িয়ে স্যামন ভাজা, সালাদ, আর সবশেষে অর্জো পাস্তা দিয়ে ফাঁকিবাজি সেমাই পিঠা দিয়ে মিষ্টিমুখ করে একেবারে পুরদস্তুর ঈদের খাওয়া হয়ে গেলো!
এই লেখা শুরু করতে গিয়ে ভেবেছিলাম আজকে পুরনো দিনের ঈদের কথা যা মনে পড়েছে সবই লিখবো। কিন্তু মনে পড়ার প্রথম কারণ, খাবারের বর্ণনা দিতে গিয়েই ইতিহাস লিখে ফেললাম। দ্বিতীয় কারণ আরেকদিন লিখবো 🙂
ঈদ মোবারক!