জীবনে সমর পার হবার সাথে সাথে মনে হয় মানুষের এলোমেলো স্মৃতি ফিরে আসার জানালাগুলোর কলকব্জা ঢিলে হতে থাকে- চাইলে খুলে ফেলা যায় বৈ কী, তবে বন্ধ করাটা বেশ কঠিন। আবার কখনো নিজে নিজেই অল্প করে খুলে গিয়ে অন্ধকার ঘরে জানালার ফোঁকর গোলে আসা আলো অথবা চির ধরা নৌকায় অল্প পরিমাণে কিন্তু তুমুল উদ্যমে গলগলিয়ে আসা পানির মতোই চারপাশের বাস্তবতা পাল্টে দেয় একরকম। এই স্মৃতির স্রোতকে না থামিয়ে আর অন্য কিছু করা যায়না ঠিকমতো- মনের মাঝে ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে।
এমন অনাকাংখিতভাবে আর কিছু না জানিয়েই এতো শক্তিশালী এই টান আসে, যে অনেক সময় একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। তা জটিল বিষয়ের কোন পড়ার বই বা পেপার না বুঝতে থাকলে, বা লেখালেখির সময় মাথায় কিছু না আসলে যেমন নিরেট দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে আর আকাশ কুসুম ভাবতে ভালো লাগে, সেটার সাথে এর হাল্কা একটু পার্থক্য আছে। তা হলঃ এই দেয়ালে তাকিয়ে থাকাটা অনেকটা ইচ্ছাকৃত, বা বলা যায় এই এলোমেলো চিন্তার ধারা কখন আসছে টের পাওয়া যায় কিছুটা, এই যে হঠাত আসা স্মৃতির কথা বলছি, এর চালচলন টের পাওয়া কঠিন।
মাঝে মাঝে খুব সাধারণ গৎবাঁধা কোন কাজ করতে গিয়েও হঠাত করে কোন অদৃশ্য শক্তি মনে হয় আগের এক সময়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন, কয়েকমাস আগের কথা – কোন এক শনিবার সপ্তাহান্তের ছুটির সুবাদে দেশি খাবার করছিলাম। নেদারল্যান্ডে বা ইউরোপেই মিষ্টি কুমড়ো সহসা পাওয়া যায় না, স্কোয়াশ বা বাটারনাট স্কোয়াশ দিয়েও দিব্যি কাজ চলে যায়। তো ওই সপ্তাহে কোন ভাবে এক তুর্কি দোকান থেকে মিষ্টিকুমড়ো পেয়েছি। আমার ভীষণ পছন্দের সবজি, তাই মনে আনন্দে কুমড়োর খোসা ছাড়িয়ে চামচ দিয়ে ভেতরের বীজগুলি বের করছিলাম। বীজের সাথের শাঁস থেকে হাতে কুমড়োর হালকা গেরুয়া – কমলার মাঝামাঝি রং লেগে যাচ্ছিলো। এমনিতে বাটারনাট স্কোয়াশে এরকম রং হয় না বীজের শাঁসে, আর হলেও ছোট দেখে হাতে না লাগিয়েও পরিষ্কার করে ফেলা যায়। আমি প্রথমে রঙের ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। বীজ আর শাঁস পরিষ্কার করে হাত ধুতে গিয়ে দেখি হাত গেরুয়া কমলায় মাখামাখি।
আমি চমকে উঠে সামলাতে পারলামনা, চলে গেলাম ৬/৭ বছর বয়সে দাদাবাড়িতে। গ্রামে পাশের বাড়িতে একটা শিউলি গাছের ঝরা ফুল কুড়োতে চলে যেতাম ফুলের সময় আসলে প্রতিদিন। আর ফুল তুলে প্রায়ই যাদের গাছ সেই খালামনি বা নানুকে (গ্রাম সম্পর্কের) কিছু ফুল দিয়ে আসতাম বা এমনিতেই গল্প করে আসতাম। কুমড়োর রঙে মাখা হাত দেখে আমার চোখে ভাসলো সেই শিউলির স্নিগ্ধ সাদা আর ঝকঝকে কমলা, যেন হেমন্তের শেষের শিশির ভেজা সকাল আর শিউলির হালকা সুঘ্রানের মিশেল টের পেলাম, পাশের বাড়ির নানুর সাথে গল্পের সময় তার মুখে পানের পিকের কারণে একটু জড়িয়ে যাওয়া স্বরে কথা শুনতে পেলাম। এই সবটা হলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডে, একেবারে সিনেমার দৃশ্যের মতো জুম আউট করে আবার হাতে ফিরে আসলাম।
উপরের লেখাটুকু বছর দুই আগে লিখেছিলাম। সাথে আরেকটা লাইন শুরু করে কয়েক শব্দ লিখে থেমে গিয়েছিলাম কোনো কারণে। মাঝে আর এ নিয়ে বসা হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে দেশে থাকা অবস্থায় এবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। ছয় বছরের ও বেশি সময় পরে গিয়েছি এবার। আরও অনেক বেশি সময় পার হয়েছে শেষ যখন সব চাচা চাচী আর চাচাতো ভাই বোনদের সাথে গিয়েছিলাম। আবার কখনো সেভাবে বাড়ি ভর্তি মানুষ মিলে যাওয়া বা থাকা হবে কিনা জানি না। সেখানে গিয়ে হঠাত মনে পড়েছে এই লেখার কথা, তাই এসে খুঁজে বের করলাম আজকে।
এতো বছর পরে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কোথায় যেন একটু শান্তি পেলাম দেখে যে কিছু জিনিস একদমই বদলায়নি। সেই ২৩ বছর আগে যেই গ্রাম থেকে মফস্বল শহরে চলে গেলাম, সেখান থেকে ব্যস্ত মহানগরে, তার পরে অন্য মহাদেশের নানান দেশে নানান শহরে – একরকম বিরতিহীন যাত্রার মতো। একদণ্ড বসে উপলব্ধি করার সময় পেলে কেবলই মনে হয় যে অনেকগুলো জীবন পেরিয়ে এসেছি। আমি নিজে কোথাকার মানুষ ভাবতে গেলে আর কোনো গ্রাম – শহর – দেশে বাঁধতে পারিনা, আমি এই পৃথিবীর মানুষ, আমি এই সীমাহীন মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র অংশ – এটাতেই এসে শেষ হয় সব ভাবনা। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকে ভাসমান কচুরিপানার মতো মনে হয়, তখন এই স্মৃতিরা আবার মনে করিয়ে দেয়, যেখানেই থাকি, বয়েসি বটের মতো ছড়ানো শেকড়ও আছে আমার। অথবা বাতাসে ভেসে বেড়ানো তুলার বীজের মতো আমার অস্তিত্ব, আমার শুরুর একটা গল্প আছে, তবে আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সেই গল্পের সাথে বাঁধা নয় – বরং আমার পথ প্রতিমুহূর্তে নতুন গল্প দেখে আর তৈরি করে। আমার, আমাদের সবার রংবেরঙের স্মৃতিরা ভালো থাকুক, আর আমাদের শুরুর গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিক এমন ক্ষণিক ঝোড়ো হাওয়ার মতো।